গত ৩ বছরে পর পর ৪ বার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলেও শেষ হয়নি নরসিংদীর বেলাব উপজেলার গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘর, উয়ারি-বটেশ্বরপ্রকল্পের নির্মাণ কাজ। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও বাজেট না বাড়ার কারণে জাদুঘরটির পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ কাজ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এদিকে প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো এই প্রত্নস্থানের প্রত্ন নিদর্শন প্রদর্শনের ব্যবস্থা না থাকায় হতাশ হয়ে ফিরছেন দর্শনাথীরা।
দর্শনাথী ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান বেলাব উপজেলার উয়ারী-বটেশ্বর। ১৯৩০ সালের দিকে স্থানীয় স্কুল শিক্ষক হানিফ পাঠান প্রথম এই প্রত্নস্থানটি সুধী সমাজের গোচরে আনেন। এরপর ২০০০ সালে ঐতিহ্য অন্বেষণ নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় প্রতœতাত্ত্বিক খনন কাজ শুরু হয় উয়ারি-বটেশ্বরে। পর্যায়ক্রমে চলা খনন কাজে এখানে পাওয়া যায় প্রাচীণ রৌপ্য মুদ্রা, বাটখারা, লৌহ কুঠার, বল্লম, পোড়ামাটির কিন্নর ও অসংখ্য পুঁথিসহ নানাবিধ প্রত্নবস্তু। প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর অল্পকিছু স্থানীয় স্কুল শিক্ষক হানিফ পাঠানের ছেলে স্কুল শিক্ষক হাবিবুল্লাহ পাঠানের ব্যক্তিগত পাঠাগারে সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়া এলাকার বেশ কয়েকটি প্রত্নস্থান খননের পর স্থায়ীভাবে প্রদর্শনের ব্যবস্থা না থাকায় আবারও মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়।
এসব প্রত্নবস্তুর স্থায়ী সংরক্ষণের পাশাপাশি দর্শনাথীদের জন্য প্রদর্শনের লক্ষে ২০১৯ সালে ৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে শুরু করা হয় গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘর, উয়ারি-বটেশ^র প্রকল্পের নির্মাণ কাজ। নরসিংদী জেলা পরিষদের অধীনে রিনা ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় শুরু হওয়া ৩ তলা বিশিষ্ট এই নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি ৩ বছরেও। দফায় দফায় ৪ বার প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হলেও কাংখিত বাজেট না বাড়ার কারণে ৬০ শতাংশ কাজে থমকে আছে প্রকল্পটি। জাদুঘর নির্মাণে কচ্ছপ গতির ফলে এখানে আগত দর্শনার্থী ও জ্ঞান পিপাসুদের এখনও ভর করতে হচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক কিছু স্থিরচিত্রের ওপরই।
নরসিংদী সরকারি কলেজ এর সাবেক অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তাফা মিয়া আমাদের নরসিংদী কে বলেন, “নতুন প্রজন্ম প্রত্নস্থান উয়ারি-বটেশ্বর সম্পর্কে বইপত্রে জানতে পারছে, পড়তে পারছে। এই স্থানকে ঘিরে বড় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এখানে এসে তারা প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন দেখতে পারছে না। মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর প্রত্নস্থানে পর্যটকরা যাচ্ছেন, দৃশ্যমান দেখতে পারছেন।”
তিনি আরও বলেন, “ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকবিদরা গবেষণার পর বলেছেন, বাংলাদেশে যতগুলো প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিস্কৃত হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন উয়ারি-বটেশ্বর। এখানে কাজ শুরু হয়েও কেন সেটা গতিহীন সেটি আমাদের দুর্ভাগ্য”।
ঐতিহ্য অন্বেষণ এর পরিচালক ড. মাহাবুবুল আলম আমাদের নরসিংদী কে বলেন, “২০০০ সাল হতে এখানে পর্যায়ক্রমে প্রত্ন খনন কাজ চলছে। এই পর্যন্ত ২১ বারের উৎখননে এখানে অসংখ্য প্রত্নবস্তুসহ স্থাপত্য নিদর্শন পাওয়া গেছে। এসব নিদর্শন পাওয়ার পর আবার অস্থায়ীভাবে সংরক্ষণের জন্য পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হচ্ছে। স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সেভাবেই রাখা হবে। আড়াই হাজার বছর আগের নগর সভ্যতার এসব নিদর্শন মাটিচাপা দেয়া থাকায় দেখতে পারছেন না পর্যটকরা। জাদুঘর নির্মাণ হলে সেসব প্রদর্শণের ব্যবস্থা করা হবে।”
নরসিংদী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো: মনির হোসেন ভূঁইয়া আমাদের নরসিংদী কে বলেন, “করোনা পরিস্থতি, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেননি ঠিকাদার। প্রথম দিকে জাদুঘরটির ড্রয়িং ডিজাইন ও অর্থ বরাদ্ধে কিছুটা সমস্যা ছিল যার কারণে কাজটি শুরু করতেও দেরি হয়। পরবর্তীতে অর্থ বরাদ্ধ আসে। এই পর্যন্ত ৬০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের জুন মাসে কাজ শেষ হওয়া কথা থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। আশা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘরের পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ কাজ শেষ হবে।”
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান আমাদের নরসিংদী কে বলেন, “গঙ্গাঋদ্ধি জাদুঘরের নির্মাণ কাজ শেষ হলে পাশাপাশি আরও কিছু স্থাপনা যদি সেখানে করা যায় তাহলে নি:সন্দেহে একটি ভাল পর্যটন নগরী গড়ে তোলা সম্ভব হবে। জেলা প্রশাসক সম্মেলনে এমন প্রস্তাব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হয়েছে এবং তিনি সেটি আশ্বস্থ করেছেন। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়েও যোগাযোগ করা হয়েছে, সেখান থেকেও হয়তো বরাদ্ধ আসবে, যাতে একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন নগরী হিসেবে উয়ারি-বটেশ্বরকে গড়ে তোলা যায়। এতে সরকার রাজস্ব পাবে”।
Leave a Reply